বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর অফশোর ব্যাংকিং ইউনিট পরিচালনায় নীতিমালা সহজ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। শর্ত শিথিল করে এই ইউনিটের নগদ জমার হার (সিআরআর) ২ শতাংশ করা হয়েছে, আগে যা ছিল সাড়ে ৪ শতাংশ। এ ছাড়া অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে একটি ব্যাংকের মূলধনের ২০ শতাংশের পরিবর্তে এখন থেকে ৩০ শতাংশ পর্যন্ত তহবিল সংগ্রহ করা যাবে। এ ছাড়া বিদ্যমান নীতিমালায় আরও কিছু সংশোধনী আনা হয়েছে। এর ফলে ব্যাংকগুলোর জন্য অফশোর ইউনিট পরিচালনা করা অনেক সহজ হবে। কারণ, ইউনিটটিতে বিপুল অঙ্কের তারল্য জমবে। আগামী মাস থেকে নতুন এসব সিদ্ধান্ত কার্যকর হবে।
জানতে চাইলে ব্র্যাক ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও পলিসি রিসার্চ ইন্সটিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, ১ লাখ কোটি টাকা প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়ন করতে হলে ব্যাংকিং খাত কিছুটা তারল্য সংকটে পড়বে। সে ক্ষেত্রে বিদেশি উৎস থেকে সস্তায় ঋণ নিতে পারলে ভালো। তা না হলে বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তারা ঋণ পাবেন না। সে কারণেই হয়তো বিদেশি এ তহবিলকে শক্তিশালী করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, ‘করোনার কারণে এখন রফতানি খাতে স্থবিরতা চলছে। এরপরও বিদেশি ঋণের চাহিদা বাড়ছে কেন-বিষয়টি স্পষ্ট নয়।’ তিনি বলেন, ‘এ বিষয়ে অতীত রেকর্ড খুব বেশি ভালো নয়। সে ক্ষেত্রে অর্থ পাচারের বিষয়ে আরও সতর্ক থাকতে হবে।’
অফশোর ইউনিট থেকে ব্যাংকগুলো বৈদেশিক মুদ্রায় ঋণ দিয়ে থাকে। এ ঋণের সুদহার ৬ শতাংশের নিচে। সম্প্রতি এ সংক্রান্ত বেশকিছু সংশোধনী এনে একটি প্রজ্ঞাপন জারি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এতে স্বাক্ষর করেন ডেপুটি গভর্নর আহমেদ জামাল ও ব্যাংকিং প্রবিধি ও নীতি বিভাগের (বিআরপিডি) মহাব্যবস্থাপক নজরুল ইসলাম।
দেশি শিল্পোদ্যোক্তাদের মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি ঋণ দেয়ার আগে বিআরপিডির অনুমোদন নেয়ার শর্ত তুলে দেয়া হয়েছে। এখন থেকে ঋণ দেয়ার পর বৈদেশিক মুদ্রানীতি বিভাগকে অবহিত করতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, ব্যাংকের অফশোর কার্যক্রমের তহবিল আহরণের সুযোগ বাড়ানো, বৈদেশিক তহবিলের ব্যবহার নিশ্চিত করা, তহবিল ব্যবস্থাপনা যথাযথ রাখার মাধ্যমে অফশোর ব্যবসার সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং অফশোর ব্যাংকিং কার্যক্রমের আরও সুষ্ঠু বিকাশের জন্য এসব সংশোধনী আনা হয়েছে। অফশোর ব্যাংকিংয়ে ঋণের চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় ব্যাংকগুলো নীতিমালা শিথিল করতে দাবি জানিয়ে আসছিল।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এ সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছেন ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি মীর নাসির হোসেন। তিনি বলেন, ‘প্রণোদনা বাস্তবায়নে ব্যাংকের তারল্যে কিছুটা টান পড়তে পারে। তাছাড়া প্রণোদনা চাহিদার তুলনায় সীমিত। সেটা সবাই পাবেও না। সে ক্ষেত্রে অফশোর ইউনিট থেকে কম খরচে বিদেশি ঋণ পেলে সেটা অনেক ভালো হবে। করোনার এই সংকটে উদ্যোগটি উপকারে আসবে।’
বিজিএমইএ-র সাবেক সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান বলেন, ‘এটা ভালো উদ্যোগ। ব্যবসায়ীরা স্বল্পসুদে ঋণ নিতে পারবেন, বিশেষ করে করোনাকালীন সংকটে উদ্যোগটি অনেক বেশি কাজে আসবে।’
দেশের বাইরে থেকে তহবিল সংগ্রহ করে রফতানিমুখী প্রতিষ্ঠানের মাঝে বিতরণের জন্য ১৯৮৫ সাল থেকে বাংলাদেশে অফশোর ব্যাংকিং কার্যক্রমের অনুমোদন দেয়া হয়। এতদিন নীতিমালা ছাড়াই চলছিল কার্যক্রম। গত বছরের ২৫ ফেব্রুয়ারি প্রথমবারের মতো অফশোর ব্যাংকিং পরিচালনার নীতিমালা জারি করে বাংলাদেশ ব্যাংক। ওই নীতিমালা অনুযায়ী, একটি ব্যাংক যে ঋণ বিতরণ করবে, তার অন্তত ৭৫ শতাংশ দেশেই বিনিয়োগ হতে হবে।
আর কোনো অবস্থায় ব্যাংকের মোট মূলধনের ২০ শতাংশের বেশি আমানত অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে সংগ্রহ করা যাবে না। এ ছাড়া ব্যাংকের দায়-সম্পদ ব্যবস্থাপনা, মূলধন, সিআরআর ও এসএলআর সংরক্ষণসহ সব ক্ষেত্রে সাধারণ ব্যাংকিংয়ের মতো নিয়ম মেনে চলতে হবে। পূর্ণাঙ্গ নীতিমালা না থাকার সুযোগ নিয়ে অফশোর ব্যাংকিং থেকে ঋণ নিয়ে নানা অপব্যবহারের তথ্য বাংলাদেশ ব্যাংকের বিভিন্ন পরিদর্শনে উঠে আসে।
অফশোর ব্যাংকিং হল ব্যাংকের অভ্যন্তরে পৃথক ব্যাংকিং। বিদেশি কোম্পানিকে ঋণ প্রদান ও বিদেশি উৎস থেকে আমানত সংগ্রহের সুযোগ রয়েছে অফশোর ব্যাংকিংয়ে। স্থানীয় মুদ্রার পরিবর্তে বৈদেশিক মুদ্রায় হিসাব হয় অফশোর ব্যাংকিংয়ে। ব্যাংকের কোনো নিয়ম-নীতিমালা অফশোর ব্যাংকিংয়ের ক্ষেত্রে প্রয়োগ হয় না। শুধু মুনাফা ও লোকসানের হিসাব যোগ হয় ব্যাংকের মূল হিসাবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী, গত বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত অফশোর ব্যাংকিংয়ের ঋণ স্থিতি দাঁড়িয়েছে ৫৯ হাজার ২২৭ কোটি টাকা। এক বছর আগে অর্থাৎ ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে ছিল ৫১ হাজার ৬৯১ কোটি টাকা। এ হিসাবে এক বছরে অফশোর ব্যাংকিংয়ের ঋণ বেড়েছে ১৪ দশমিক ৫৮ শতাংশ।