ভারত-বাংলাদেশ বাণিজ্যে খুলছে নতুন নতুন ‘সাপ্লাই চেইন’

Seven-Sister-1.jpg

নতুন রুটে যুক্ত হয়েছে নৌপথ

আন্তর্জাতিক ডেস্ক :

চিরাচরিতভাবেই ভারত-বাংলাদেশ বাণিজ্যের ‘নার্ভসেন্টার’ হলো পেট্রাপোল-বেনাপোল আন্তর্জাতিক স্থলবন্দর। দুই দেশের মধ্যে আমদানি-রফতানির প্রায় আশি শতাংশই সীমান্ত পারাপার করে এই বন্দর দিয়ে। কিন্তু সেই ছবিটা এবার দ্রুত পাল্টাতে চলেছে। আর তার কারণ, সমুদ্র ও নদীপথে এবং রেলপথে দুই দেশের মধ্যে খুলে যাচ্ছে নতুন নতুন সব সাপ্লাই চেইন।

বস্তুত মাত্র গত কয়েক দিনের মধ্যে ভারত ও বাংলাদেশের বাণিজ্যে এমন কয়েকটি নতুন রুট খুলে গেছে বা চালু হয়েছে যা কিছুদিন আগেও অকল্পনীয় ছিল। কিছুটা পশ্চিমবঙ্গ সরকারের বাধায় ও কিছুটা করোনা আতঙ্কে পেট্রাপোল সীমান্তে মালপত্র খালাসের কাজ বহুদিন বন্ধ ছিল। সেই প্রতিবন্ধকতাও এই নতুন সাপ্লাই লাইনগুলো চালু করার ক্ষেত্রে ‘ক্যাটালিস্টে’র কাজ করেছে।

এই সব নতুন রুট বা সাপ্লাই চেইনের কয়েকটি উদাহরণ:

১) ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে পয়েন্ট-টু-পয়েন্ট পার্সেল ট্রেন (কার্গো বা মালবাহী), যা সীমান্ত পার হচ্ছে রেলপথে গেদে-দর্শনা চেকপোস্ট দিয়ে। এর মধ্যেই মহারাষ্ট্র থেকে পেঁয়াজ ও চিনির বিশাল চালান এই পথে বাংলাদেশে আসে। গত সপ্তাহেই প্রথমবারের মতো অন্ধ্রপ্রদেশের গুন্টুর থেকে শুকনা মরিচের পার্সেল ভ্যানও (মালগাড়ি) বাংলাদেশে পৌঁছেছে।

২) কলকাতা-হলদিয়া বন্দর থেকে বাংলাদেশের চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দর পর্যন্ত পণ্য চলাচলও শুরু হয়ে যাচ্ছে। এ সপ্তাহের গোড়াতেই কলকাতার শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি পোর্ট থেকে চট্টগ্রামের উদ্দেশে রওনা হয়েছে এমভি (মার্চেন্ট ভেসেল) সেঁজুতি, যা চট্টগ্রাম বন্দরে গিয়ে পৌঁছনোর কথা সোমবার (২০ জুলাই)। সেঁজুতি যে সব কন্টেইনার নিয়ে যাচ্ছে তা মূলত ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোর জন্য হলেও এই পথে আগামী দিনে বাংলাদেশের জন্যও পণ্য আসতে পারবে।

৩) এর মধ্যেই চালু হয়ে গেছে নতুন নতুন ইনল্যান্ড ওয়াটার প্রোটোকল (আই ডব্লিউ পি), সোজা কথায় যাকে বলে অভ্যন্তরীণ নদীপথে বাণিজ্য। কলকাতা থেকে সুন্দরবন-মোংলা-খুলনা হয়ে নদীপথে ঢাকা পর্যন্ত পর্যটকদের নিয়ে প্রমোদ তরীর ট্রায়াল রান সম্পন্ন হয়েছে অনেক আগেই। এখন সেই একই পথে কার্গো চলাচলের প্রস্তুতিও সম্পন্ন।

বস্তুত ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে চার জোড়া রেল রুটের জন্য আই ডব্লিউ পি প্রোটোকল স্বাক্ষরিত হয়েছে বেশ কয়েক বছর আগেই, এখন সেগুলো যে কোনও সময় চালু হওয়ার অপেক্ষায়। এই রুটগুলো হলো (দুই দিকেই):

ক. কলকাতা-খুলনা-মোংলা-বরিশাল-হিজলা-চাঁদপুর-নারায়ণগঞ্জ-আরিচা-সিরাজগঞ্জ-বাহাদুরাবাদ-চিলমারি-ধুবড়ি-পান্ডু-শিলঘাট

খ. কলকাতা-মোংলা-কাউখালি-বরিশাল-হিজলা-চাঁদপুর-নারায়ণগঞ্জ-ভৈরববাজার-আশুগঞ্জ- আজমেরিগঞ্জ-মারকিউলি-শেরপুর-ফেঞ্চুগঞ্জ-জকিগঞ্জ- করিমগঞ্জ

গ. রাজশাহী-গোদাগাড়ি-ধুলিয়ান

ঘ. করিমগঞ্জ-জকিগঞ্জ-ফেঞ্চুগঞ্জ-শেরপুর-মারকিউলি-আজমেরিগঞ্জ-আশুগঞ্জ ভৈরববাজার- নারায়ণগঞ্জ-চাঁদপুর-আরিচা-সিরাজগঞ্জ-বাহাদুরাবাদ-চিলমারি-ধুবড়ি-পান্ডু-শিলঘাট

৪) এ ছাড়াও নেপাল ঘেঁষে ও উত্তর-পূর্ব ভারতের দিকে আরও বেশ কয়েকটি স্থলবন্দর বা আইসিপি-তেও (ইন্টিগ্রেটেড চেকপোস্ট) দ্রুতগতিতে অবকাঠামো নির্মাণের কাজ করছে ভারতের ল্যান্ড পোর্টস ডেভেলপমেন্ট অথরিটি।

এই আইসিপি-গুলোর মধ্যে আছে আগরতলা (ত্রিপুরা), ডাউকি (মেঘালয়), কাউরপুইছুয়া (মেঘালয়), সুতারকান্দি (আসাম), হিলি, চ্যাংড়াবান্ধা, মাহদিপুর, ফুলবাড়ি, ঘোজাডাঙা (পশ্চিমবঙ্গ)। এই স্থলবন্দরগুলো পুরোপুরি চালু হয়ে গেলে পেট্রাপোল-বেনাপোলের ওপর ভরসা করে বসে থাকতে হবে না বলাই বাহুল্য।

দিল্লির গবেষণা প্রতিষ্ঠান রিসার্চ অ্যান্ড ইনফর্মেশন সিস্টেম ফর ডেভেলপিং কান্ট্রিজে (আর আই এস) অধ্যাপনা করেন অর্থনীতিবিদ ড. প্রবীর দে। আঞ্চলিক কানেক্টিভিটি-র এই বিশেষজ্ঞ বাংলা ট্রিবিউনকে বলছিলেন, ‘যেহেতু এখন ক্রমশ বোঝা যাচ্ছে করোনাভাইরাসের সঙ্গেই আমাদের আগামী বেশ কিছুকাল দিন কাটাতে হবে – তাই এই নতুন সাপ্লাই চেইনগুলোকে সাপোর্ট করা খুবই দরকার। এতে করে আমাদের পণ্যের কম্পিটিটিভনেস-ই শুধু বাড়বে না, ভ্যালু চেইনটাও শক্তিশালী হবে। অর্থাৎ অনেক সহজ হবে পণ্যে ভ্যালু অ্যাডিশন করা রফতানিকারকরা অনেক দ্রুত তা বাংলাদেশে পাঠাতে পারবেন।’

‘বেনাপোল-পেট্রাপোলের ওপর অতিরিক্ত নির্ভরতা আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের কতটা ক্ষতি করছে তা আমরা সবাই দেখতে পাচ্ছি। এই পরিস্থিতিতে আমার অভ্যন্তরীণ নদীপথের ওপর জোর দিতে হবে। কারণ সেটা অনেক সাশ্রয়ী ও টেকসই পদ্ধতি’ বলছিলেন প্রবীর দে।

বেনাপোল-পেট্রাপোল স্থল সীমান্ত

ভারত ও বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ নদীপথগুলোকে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের জন্য আরও কার্যকরী উপায়ে কীভাবে ব্যবহার করা যায়, তা নিয়ে দুই-চারদিন আগেই একটি ওয়েবিনারের আয়োজন করেছিল মেঘালংয়ের শিলং-ভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ‘এশিয়ান কনফ্লুয়েন্স’।

বাংলাদেশের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম ও ঢাকায় নিযুক্ত ভারতের রাষ্ট্রদূত রিভা গাঙ্গুলি দাস দুই জনেই সেই অনলাইন সেমিনারে যোগ দিয়ে বলেছেন, এই নদীপথগুলোই হলো দুই দেশের বাণিজ্যের ভবিষ্যৎ!

ওই আলোচনাচক্রে দুদেশের নীতি-নির্ধারক, শিল্পপতি, গবেষকরাও সবাই এক বাক্যে বলেছেন, বেনাপোলের চেকপোস্টে ট্রাকে মাল ওঠানামার বাইরে গিয়েও দুই দেশকে ভাবতে হবে মালগাড়ি বা কার্গো জাহাজের দিকে কীভাবে ফোকাস-টা সরানো যায়। মানে, সেই নতুন নতুন সাপ্লাই চেইন!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

scroll to top