বিশেষ প্রতিবেদক :
সরকারের গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়ন, রাস্তাঘাট নির্মাণ, দুস্থদের ভাতা, করোনা সহায়তা প্রদানসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে পর্যাপ্ত সরকারি বরাদ্দ দেওয়ার পরও বিভিন্ন জেলা-উপজেলায় দুর্নীতি বাড়ছে। করোনা পরিস্থিতিতেও থেমে নেই এর ধারাবাহিকতা। এ ক্ষেত্রে অনেক জনপ্রতিনিধির সংশ্নিষ্টতার অভিযোগ উঠেছে। তবে জনপ্রতিনিধিদের অনেকে জানাচ্ছেন, মাঠ প্রশাসনের কর্মকর্তাদের দুর্নীতি-অনিয়মের প্রতিবাদ করায় উদ্দেশ্যমূলকভাবে তাদের হয়রানি করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে নগদ অর্থ সহায়তা কর্মসূচির তালিকা প্রণয়নে অনিয়ম ও দুর্নীতি এবং মসজিদের ইমামের নামের টাকা বিতরণেও স্বজনপ্রীতির অভিযোগ উঠেছে। এ নিয়েও বিভিন্ন সংস্থা তদন্ত করছে।
দুর্নীতি-অনিয়মের অভিযোগে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব শুরু হওয়ার পর গত তিন মাসে স্থানীয় সরকার (ইউনিয়ন পরিষদ) আইন ২০০৯-এর ৩৪(১) ধারা অনুযায়ী ১১২ জনপ্রতিনিধিকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয়েছে। তাদের মধ্যে ৩৪ জন ইউপি চেয়ারম্যান, ৭১ জন ইউপি সদস্য, ১ জন জেলা পরিষদ সদস্য, ৪ জন পৌর কাউন্সিলর এবং ২ জন উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান। স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ সমকালকে বলেন, যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে, তাদের বিরুদ্ধে মন্ত্রণালয় থেকে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। এ পর্যন্ত শতাধিক জনপ্রতিনিধির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। উন্নয়ন প্রকল্পে যে সব জনপ্রতিনিধি দুর্নীতি করেছেন, তাদের বিরুদ্ধে মামলাও হয়েছে। অনেক জনপ্রতিনিধি জেলে আছেন। দুর্নীতিবাজদের ছাড় দেবে না সরকার।
প্রসঙ্গত, স্থানীয় সরকার (উপজেলা পরিষদ) আইনের ২৫ ধারা অনুযায়ী সব সিদ্ধান্ত পরিষদের মাধ্যমে নেওয়ার এবং পরিষদের চেয়ারম্যান কর্তৃক অনুমোদনের বিধান রয়েছে। তবে এ বিধান না মানায় এবং ক্ষেত্রবিশেষে ইউএনওরা স্থানীয় এমপিকেই বেশি গুরুত্ব দেওয়ায় চেয়ারম্যান ও ইউএনওর মধ্যে দ্বন্দ্ব তীব্র হয়ে উঠেছে। এই দ্বন্দ্বের রেশ ধরে অনেক দুর্নীতি-অনিয়মের বিস্তারিত খবর প্রকাশ্যে বেরিয়ে আসছে এবং তাতে জনগণের মধ্যেও ক্ষোভ দেখা দিচ্ছে।
গত ১৪ মে নওগাঁর বদলগাছী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আবু তাহিরের বিরুদ্ধে টেন্ডার ছাড়াই ভবন ভাঙা, দুর্যোগ মোকাবিলা তহবিল থেকে ত্রাণ বিতরণের নামে পাঁচ লাখ টাকা তুলে এককভাবে ব্যয় করা এবং কৃষকের উপস্থিতি ছাড়াই লটারি করাসহ বিভিন্ন অভিযোগে বদলগাছী প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করেন উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান শামসুল আলম খান। এ ঘটনার চার দিন পর গত ১৮ মে স্থানীয় সরকার বিভাগ থেকে এই চেয়ারম্যানকে বরখাস্ত করা হয়।
নরসিংদীর শিবপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) বিরুদ্ধে উপজেলা চেয়ারম্যানসহ ৯টি ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান মন্ত্রণালয়ে অভিযোগ দিলেও কোনো প্রতিকার পাচ্ছেন না। অভিযোগ রয়েছে সব রকম বরাদ্দে ইউএনওর ঘুষ নেওয়ার ঘটনা ওপেন সিক্রেট। এমনকি সরকারের অতিদরিদ্র কর্মসূচিতেও তিনি ১৫ শতাংশ ঘুষ নেন বলে অভিযোগ আছে। ঘুষ দিতে অস্বীকার করায় স্থাবর সম্পত্তি হস্তান্তর করের (১%) বরাদ্দ ৯ মাস ধরে জয়নগর ইউনিয়ন পরিষদে বন্ধ রেখেছেন তিনি। ইউএনওর প্রতি জেলা প্রশাসকের আশীর্বাদ থাকায় তিনি এমন বেপরোয়া হয়ে উঠেছেন বলে অভিযোগ তাদের।
২০১৮ সালের ২১ অক্টোবর নরসিংদীর শিবপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসার হিসেবে যোগ দেন হুমায়ুন কবির। এর আগে তিনি জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের আরডিসি ছিলেন। রায়পুরা উপজেলায় সহকারী কমিশনার (ভূমি) অফিসেও কাজ করেছেন তিনি। সম্প্রতি শিবপুরের এই ইউএনওর বিরুদ্ধে জেলা প্রশাসকের প্রশ্রয়ে ঘুষ নেওয়া, অর্থ আত্মসাৎসহ সরকারের উন্নয়ন ও পৌরসভার উন্নয়ন কার্যক্রমের নামে ব্যাপক সরকারি অর্থ লুটপাটের অভিযোগ এনেছেন শিবপুর উপজেলা চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি, সাধারণ সম্পাদকসহ ৯টি ইউনিয়নের সব চেয়ারম্যান।
শিবপুর উপজেলা চেয়ারম্যান হারুনুর রশিদ খান বলেন, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা হুমায়ুন কবির ইউনিয়ন পরিষদের বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজ থেকে ১০ শতাংশ হারে, এলজিইডি শাখা থেকে ৫ শতাংশ হারে, প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার কাছ থেকে ১৮ শতাংশ হারে, পৌরসভার উন্নয়ন কাজে ২০ শতাংশ হারে, প্রতি নামজারিতে দুই হাজার টাকা এবং বালু উত্তোলনে ট্রাকপ্রতি ৫০০ টাকা সরাসরি ঘুষ নিয়ে থাকেন। এ ব্যাপারে দুইবার জেলা প্রশাসককে (ডিসি) নির্দেশনা দেয় মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। কিন্তু কিছুই হয়নি।
এদিকে কক্সবাজারের পেকুয়ায় ত্রাণের ১৫ টন চাল আত্মসাতের ঘটনায় এরই মধ্যে তদন্ত শেষ করেছে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় গঠিত তদন্ত কমিটি। গত ৪ মে দিনভর পেকুয়ার সব চেয়ারম্যান, ইউপি সচিব, পিআইও এবং উপজেলা কর্মকর্তাদের সাক্ষ্য নিয়েছে তদন্ত কমিটি। এরপর গত ১০ মে দ্বিতীয় পর্যায়ে এ বিষয়ে আরও শুনানির জন্য পেকুয়া উপজেলা নির্বাহী অফিসারসহ ৯ কর্মকর্তা-কর্মচারীকে চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনার কার্যালয়ে তলব করা হয়।
এদিকে স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ ড. তোফায়েল আহমদ বলেছেন, ‘জনপ্রতিনিধি যেখানে ৬০ হাজার, সেখানে ১০০-২০০ জনকে বরখাস্ত করলেই দুর্নীতি বন্ধ হবে না। বর্তমানে প্রশাসনের কর্মকর্তা থেকে শুরু করে জনপ্রতিনিধিরা পর্যন্ত সরকারদলীয় হওয়ায় একদিকে যেমন উন্নয়নমূলক কাজ কমছে, অন্যদিকে সরকারি কোষাগারের টাকা নিয়ে লুটপাট ও দুর্নীতি বাড়ছে।’
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘বেশির ভাগ খাতেই দীর্ঘদিনের দুর্নীতি-অব্যবস্থাপনা নিয়ন্ত্রণ ও সুশাসন নিশ্চিতে জোরালো পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। করোনাপরবর্তী অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের নামে সরকারের দুর্নীতিবিরোধী অঙ্গীকার ও দেশের সব প্রচলিত আইনকে উপেক্ষা করা হয়েছে চলতি বাজেটে। এটি প্রধানমন্ত্রীর ঘোষিত দুর্নীতির প্রতি শূন্য সহনশীলতার সম্পূর্ণ বিপরীত ও অমর্যাদাকর পদক্ষেপ- যা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। সংবিধানের ২০(২) অনুচ্ছেদের পরিপন্থি এই ব্যবস্থা সৎপথে উপার্জনকারী নাগরিকের প্রতি বৈষম্যমূলক।’