শাহ মনসুর আলী নোমান ::
সিলেটের সবুজ-শ্যামল রূপ, নৈসর্গিক সৌন্দর্য ও জীবন প্রবাহে মুগ্ধ হয়ে কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন,
মমতাহীন কালস্রোত
বাঙলার রাষ্ট্রসীমা হোতে
নির্বাসিতা তুমি,
সুন্দরী শ্রীভূমি।
ইতিহাস-ঐতিহ্য, শিক্ষা-সংস্কৃতি, শিল্প-সাহিত্য, রাজনীতি-সমাজনীতি’তে সু-সমৃদ্ধ সিলেট বাংলাদেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রাচীন জনপদ। সিলেট অর্থনৈতিকভাবে দেশের একটি সমৃদ্ধশালী অঞ্চল হিসেবে পরিচিত। হযরত শাহজালাল (রঃ) এবং হযরত শাহপরান (রঃ) এর পবিত্র স্মৃতি বিজড়িত পূন্যভূমি সিলেট শুধুমাত্র দেশের আধ্যাত্মিক রাজধানীই নয়; বরং সিলেটের প্রাকৃতিক সম্পদ, নয়নাভিরাম সৌন্দর্যের ধারা, চা বাগান, অসংখ্য ছোট-বড় টিলা, নদী, জলধারা, সবুজের সমারোহ এবং অনেক প্রাচীনতম স্থপনা সমূহ অতি সহজেই সবাইকে আকৃষ্ট করে। ‘দুটি পাতা একটি কুঁড়ির দেশ সিলেটকে যেন মহান আল্লাহ তাআলা অকৃপণভাবে গড়েছেন। ‘প্রকৃতি কন্যা’ সিলেটের প্রতি সবার রয়েছে এক চিরন্তন আকর্ষন এবং ভ্রমণপ্রেমীদের একটি প্রিয় স্থান।
সিলেট বিভাগের চারটি জেলায় ছড়িয়ে আছে অনেক প্রাচীন দর্শনীয় স্থাপনা, এমনকি সিলেট শহরেই দেখার মতো অনেক স্থাপনা রয়েছে।
সিলেট শহরের ‘শাহী ঈদগাহ’ নামক স্থানটি জ্ঞান ও ভ্রমণ পিপাসু লোকদের নিকট একটি আকর্ষনীয় স্থাপনা। এখানেই সৈয়দ মোহাম্মদ হাদী ও সৈয়দ মোহাম্মদ মেহেদী (পীরজাদা নামে সুপরিচিত) ভ্রাতৃদ্বয়ের নেতৃত্বে ১৭৮২ খ্রীস্টাব্দে, ইংরেজদের সাথে ভারত-বাংলা জতীয়তাবাদের প্রথম আন্দোলন সংগঠিত হয়। এই আন্দোলনে সৈয়দ ভ্রাতৃদ্বয় শহীদ হন।
অহিংস আন্দোলনের নেতা মাহাত্মা গান্ধী, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, শেরেবাংলা একে ফজলুল হক, মাওলানা মোহাম্মদ আলী সহ অনেক বর্ষীয়ান নেতাদের পাদস্পর্শে ধন্য সিলেটের এই ‘শাহী ঈদগাহ’ নামক স্থানটি। সে সময়ে বিভিন্ন সভা সমাবেশ ও রাজনৈতিক আয়োজানের জন্য উপযুক্ত স্থান হিসেবে বেছে নেয়া হত ‘শাহী ঈদগাহ’কে।
‘শাহী ঈদগাহ’ দেশের প্রাচীনতম একটি ঈদগাহ। অতি মনোমুগ্ধকর কারুকার্যমন্ডিত এই স্থাপনাটি মোগল ফৌজদার ফরহাদ খাঁ ১৭শ শতকের প্রথম দিকে নির্মাণ করেন। উঁচু টিলার উপর প্রাচীন এই ঐতিহ্যবাহী ঈদগাহের অবস্থান এবং ‘শাহী ঈদগাহে’র নামানুসারেই স্থানটির নামকরন করা হয়। খুবই চমৎকার সিঁড়ি মাড়িয়ে উপরে উঠলে গম্বুজ সজ্জিত ঈদগাহের অবস্থান এবং এর প্রাচীর সীমার চারদিকে রয়েছে একাধিক গেইট। ঈদগাহ’র সম্মুখে রয়েছে একটি সুন্দর পুকুর। এই শাহী ঈদগাহে প্রতিবছর ঈদুল আযহা ও ঈদুল ফিতর নামাজের বিশাল জামাত অনুষ্ঠিত হয়। সিলেটের এই ঐতিহ্যবাহী ‘শাহী ঈদগাহ’ ময়দানে একসাথে প্রায় দেড় লক্ষ মুসল্লি নামাজ আদায় করতে পারেন বলে স্থানীয় বাসীদের অভিমত। কিন্তু বৈশ্বিক মহামারী করোনাভাইরাসের কারণে সরকারী বিধি-নিষেধ থাকায় এই বছর শাহী ঈদগাহে কোন ঈদের জামাত অনুষ্ঠিত হয়নি।
শাহী ঈদগাহ সিলেট নগরের প্রাচীন স্থাপত্য কীর্তির অন্যতম নিদর্শন মোগল আমলের স্মৃতি বহনকারী একটি স্থাপনা। সাবেক অর্থমন্ত্রী আবু মাল আব্দুল মুহিতের প্রচেষ্টা ও উদ্যোগে ‘মিনার কমপ্লেক্স’ নির্মিত হওয়ায় শাহী ঈদগাহের সৌর্ন্দয আরও অধিক বৃদ্ধি পেয়েছে।
সিলেট সার্কিট হাউস, কাজির বাজার ব্রীজ, সিলেট রেলওয়ে স্টেশন, নর্থ ইস্ট ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ ও কদমতলী বাস টার্মিনাল থেকে প্রায় ৪/৫ কিলোমিটার দূরত্বের মধ্যে এবং সিলেট ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর থেকে প্রায় ৭ কিলোমিটার দূরত্বের মধ্যে ‘শাহী ঈদগাহ’র অবস্থান।
সিলেট নগরীর আম্বরখানা পয়েন্ট থেকে টিলাগড়গামী অটোরিক্সা সিএনজিতে করে ‘শাহী ঈদগাহে’ দশ মিনিটের যাতায়াত করা সম্ভব।(যানজট না থাকলে) নগরীর জেল রোড, কোর্ট পয়েন্ট, বন্দর বাজার এলাকা থেকে অটোরিক্সা সিএনজি নিয়ে সহজেই ‘শাহী ঈদগাহে’ আসা যায়।
সিলেটের এতিহ্যবাহী, প্রাচীনতম, নান্দনিক কারুকার্য মন্ডিত এই ‘শাহী ঈদগাহ, মিনার কমপ্লেক্স’ এবং এর পার্শ্ববর্তী সবুজ শ্যামল দৃশ্যাবলী দেখতে প্রতিদিন দেশী-বিদেশী পর্যটকরা এখানে ভিড় জমান।
লেখক :: উপচার্য মহোদয়ের একান্ত সচিব, নর্থ ইস্ট ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ, সিলেট।