আগামীকাল শহীদ কর্নেল তাহের দিবস

Taher-2020.jpg

ডেস্ক রিপোর্ট :

আগামীকাল ২১ জুলাই শহীদ কর্নেল তাহের ৪৪তম হত্যা দিবস। দেশের প্রথম সামরিক সরকার জিয়াউর রহমানের সামরিক আদালত ১৯৭৬ সালের এ দিন ভোর চারটায় ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে তাঁকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করে। শহীদ কর্নেল আবু তাহের ছিলেন মুক্তিযুদ্ধে ১১ নম্বর সেক্টরের সেক্টর কমান্ডার, পরবর্তীকালে ১৯৭২ সালে গঠিত জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদ এর কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সভাপতি এবং ৭ নভেম্বরের ঐতিহাসিক মহান সিপাহী-জনতার অভ্যুত্থানের নায়ক।

করোনা মহামারি পরিস্থিতির কারণে ঢাকায় কেন্দ্রীয় কার্যকরী কমিটি এবং দলের জেলা-উপজেলা কমিটিগুলো স্বাস্থ্যবিধি মেনে শারীরিক দূরত্ব বজায় রেখে মাস্ক পরে কর্নেল তাহেরের প্রতিকৃতিতে মাল্যদান ও শ্রদ্ধা নিবেদন করে সংক্ষিপ্ত কর্মসূচির মাধ্যমে এবারের কর্নেল তাহের দিবস পালন করবে।

জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু এমপি ও সাধারণ সম্পাদক শিরীন আখতার এমপি কেন্দ্রীয় কর্মসূচির মতো করে স্বাস্থ্যবিধি মেনে যথাযোগ্য মর্যাদায় সংক্ষিপ্তভাবে ৪৪তম শহীদ কর্নেল তাহের দিবস পালনের জন্য জেলা ও উপজেলা কমিটিগুলোর প্রতি নির্দেশ প্রদান করেছেন।

বীর উত্তম শহীদ কর্ণেল আবু তাহের-র সংক্ষিপ্ত জীবনী :

১৯৩৮ সালের ১৪ নভেম্বর আসামের বদরপুর স্টেশনে নানার বাসায় আবু তাহেরের জন্ম। ১৯৫২ সালে একজন কিশোর হিসেবে তিনি ভাষা আন্দোলনে যোগ দেন। ১৯৫৫ সালে তিনি চট্টগ্রাম ফতেহাবাদ স্কুল থেকে মাধ্যমিক, ১৯৫৭ সালে সিলেটের এমসি কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক ও ১৯৫৯ সালে একই কলেজ থেকে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৬০ সালে ঢাকা বিশেববিদ্যালয়ে সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটে এমএ প্রথম পর্বে অধ্যয়ন করেন। এ বছরই তিনি সেনাবাহিনীতে যোগ দেন ও বালুচ রেজিমেন্টে কমিশন লাভ করেন। ১৯৬৫ সালে তিনি পাক-ভারত যুদ্ধে কাশ্মীর ও শিয়ালকোট সেক্টরে অংশগ্রহণ করেন, যুদ্ধাহত হন ও পরে প্যারা কমান্ডো গ্রুপ ‘স্পেশাল সার্ভিসেস গ্রুপ’-এ যোগ দেন। ১৯৬৭–১৯৬৯ সময়কালে তিনি চট্টগ্রামের ডাবলমুরিং এলাকায় দ্বিতীয় কমান্ডো ব্যাটালিয়নে কর্মরত ছিলেন।

১৯৬৯ সালে তিনি ঢাকা ও চট্টগ্রামে ছাত্র-তরুণদের সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের জন্য সামরিক প্রশিক্ষণ প্রদান করেন। এ বছর তিনি মেজর পদে উন্নীত হল; বিয়ে করেন; স্ত্রী লুৎফা তাহের ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণরসায়ন বিভাগের ছাত্রী। বছরের শেষ দিকে তাকে পাকিস্তানের আটক ফোর্টে বদলী করা হয় ও স্পেশাল কমান্ডো গ্রুপের কমান্ডার নিয়োগ করা হয়। ১৯৭০ সালে তিনি ‘মেরিন প্যারাসুট উইং’ পান ও উচ্চতর সামরিক প্রশিক্ষণর জন্য আমেরিকা যান। জর্জিয়ার ফোর্ট বেনিং-এর রেঞ্জার ট্রেনিং ইনস্টিটিউট থেকে ‘রেঞ্জার’ পদকে ভূষিত হন। একই বছর তিনি নর্থ ক্যারোলিনার ফোর্ট ব্রাগের স্পেশাল ফোর্সেস অফিসার্স ট্রেনিং ইনস্টিটিউট থেকে সম্মানসহ স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৭০-এর জুলাই মাসে তিনি আটক ফোর্টে প্রত্যাবর্তন করেন।

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ বাংলাদেশে পাকিস্তান বাহিনী গণহত্যা শুরু করার পর ৩০ মার্চ কোয়েটা ইনফ্যান্ট্রি স্কুলে তাহেরের সিনিয়র টেকনিক্যাল কোর্স অসমাপ্ত অবস্থায় শেষ করে দেয়া হয়। ১৯৭১-এর ১ এপ্রিল থেকে তাঁকে নজরবন্দি করা হয়। ৭ এপ্রিল কোয়েটা থেকে খারিয়া যাবার পথে পাকিস্তানী বিমান ছিনতাইয়ের পরিকল্পনা করে ব্যর্থ হন। ১৯৭১-এর ৮ থেকে ২৮ এপ্রিলের মধ্যে তিনি ক্যাপ্টেন দেলোয়ার ও ক্যাপ্টেন পাটোয়ারিকে নিয়ে পাকিস্তান থেকে পালানোর চেষ্টা করেন। পরে তাকে খারিয়া থেকে এবোটাবাদ বেলুচ রেজিমেন্টাল সেন্টারে বদলি করা হয়। ২৯ এপ্রিল আবারো পালানোর চেষ্টা করেন ও মীরপুর শহর থেকে ফিরে আসতে বাধ্য হন। অবশেষে ২৫ জুলাই মেজর জিয়াউদ্দিন, মেজর মঞ্জুর ও ক্যাপ্টেন পাটোয়ারি এবং মঞ্জুরের পরিবার সদস্যদের নিয়ে ভারতীয় সিমান্ত ঘাঁটি দেবীগড় পৌঁছান। দেবীগড় থেকে ২৭ জুলাই তিনি দিল্লী পৌঁছান। আগস্টের প্রথম সপ্তাহে দিল্লী থেকে মুজিবনগর পৌঁছান। সেনাপ্রধান কর্তৃক নিয়োজিত হয়ে বিভিন্ন সেক্টরের যুদ্ধ পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে তাঁর মতামত প্রদান করেন।

১১ নম্বর সেক্টর গঠন করে তাঁকে সেক্টর কমান্ডার নিয়োগ করা হয়। মুক্তিযুদ্ধে ১১ নম্বর সেক্টর অসংখ্য যুদ্ধ পরিচালনা করে; তাহের ঐতিহাসিক কামালপুর অভিযান ও চিলমারী রেইড পরিচালনা করেন। ১৪ নভেম্বর নিজ জন্মদিনে কামালপুর সম্মুখ সমরে আহত হন; বাম পা হাঁটুর উপর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়। ১৯৭২ সালে হাসপাতাল (পুনা আর্টিফিশিয়াল লিম্ব সেন্টার) থেকে দেশে ফেরেন। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রথম অ্যাডজুট্যান্ট জেনারেলের পদ পান; পরে জুন মাসে তাকে কুমিল্লায় ব্রিগেড কমান্ডার হিসেবে বদলী করা হয়। সেপ্টেম্বরে ডিফেন্স পারচেজের ডিরেক্টর জেনারেল হিসেবে করা হয়।

১৯৭২ সালের ২২ সেপ্টেম্বর তিনি সেনাবাহিনী থেকে পদত্যাগ করেন; বঙ্গবন্ধুকে দেয়া পদত্যাগপত্রে তিনি উল্লেখ করেন যে প্রধানমন্ত্রী দেশের বাইরে থাকার সময় তাঁকে ক্ষমতাচ্যুত করার চেষ্টা হয়েছিল; সেনাপ্রধান তা বঙ্গবন্ধুকে জানিয়েছিলেনও, কিন্তু ষড়যন্ত্রকারীদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেয়া হয়নি; পদত্যাগপত্রে তিনি বলেন যে তিনি জনগণের কাছেই ফেরত যেতে চান ।

১৯৭২-এর শেষ দিকে কর্নেল তাহের জাসদে যোগ দেন। ১৯৭৩-এর জানুয়ারিতে ড্রেজিং সংস্থার ডিরেক্টর হিসেবে দায়িত্ব পান। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যা ও ৩ নভেম্বরের ক্যু’র মাধ্যমে সামরিক বাহিনীর অফিসারদের কামড়াকামড়ির বিপরীতে ৭ নভেম্বর বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার নেতৃত্বে, বিপ্লবী গণবাহিনীর সহায়তায় ও জাসদের সমর্থনে সংঘটিত করেন ঐতিহাসিক মহান সিপাহী-জনতার অভ্যুত্থান।

অভ্যুত্থানে মুক্ত জেনারেল জিয়া অভ্যুত্থানের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেন। ২৩ নভেম্বর জিয়া তাহেরকে গ্রেফতার করেন। ১৯৭৬ সালের ১৫ জুন পাকিস্তান ফেরত কর্নেল ইউসুফ হায়দারকে চেয়ারম্যান করে সরকার এক নম্বর বিশেষ সামরিক আদালত গঠনের ঘোষণা দেয়। ২১ জুন ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বিশেষ নিচ্ছিদ্র নিরাপত্তা ব্যবস্থায় আদালত কার্যক্রম শুরু করে। ১১-১৪ জুলাইয়ের মধ্যে অভিযুক্তগণ জবানবন্দি প্রদান করেন; কর্নেল তাহের গোপন সামরিক আদালতের বিভিন্ন বাধাবিপত্তি উপেক্ষা করে টানা ছয় ঘণ্টা তাঁর ঐতিহাসিক জবানবন্দি প্রদান করেন।

১৭ জুলাই আদালত কর্নেল তাহেরের মৃত্যুদণ্ড আর সিরাজুল আলম খান, মেজর এম এ জলিল, আসম আবদুর রব, হাসানুল হক ইনু, মেজর জিয়াউদ্দিন, এডভোকেট রবিউল আলম, ড. আনোয়ার হোসেন, আবু ইউসুফ খান ও সালেহা বেগমসহ অপরাপর জাসদ নেতা ও বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার নেতাদের বিভিন্নমেয়াদী সাজা প্রদান করে। ২১ জুলাই ভোর চারটায় কর্নেল তাহেরকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করে। নেত্রকোণার কাজলায় নিজ গ্রামে তাঁকে সমাহিত করা হয়। তাঁর কবরের পাশে সামরিক ছাউনি ফেলে ১১ আগস্ট পর্যন্ত প্রহরা দেয়া হয়।

কর্নেল তাহেরকে হত্যার ১০ দিন পর ৩১ জুলাই গোপন সামরিক আদালতকে বৈধতা দেয়ার জন্য সামরিক আইনের ২০তম সংশোধনী জারি করা হয়। সংবিধানে পঞ্চম সংশোধনী আরোপনের মাধ্যমে জিয়া ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট থেকে ১৯৭৯ সালের ৯ এপ্রিল পর্যন্ত সামরিক কর্তৃপক্ষের সকল অপকর্মের বিরুদ্ধে প্রশ্ন উত্থাপনকে রহিত করেন।

২০১১ সালের ১১ মার্চ দেশের সর্বোচ্চ আদালত কর্নেল তাহেরকে মহান দেশপ্রেমিক ও জিয়াকে ঠান্ডা মাথার খুনী রায় প্রদান কর :

শহীদ কর্নেল তাহেরের আত্মদানের ৩৫ বছর পর ২০১০ সালে মহামান্য আদালত সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী বাতিল ঘোষণা করেন। এ সাংবিধানিক বাধা দূর হবার পর তাহের পরিবার ও জাসদ নেতৃবৃন্দের বেশ কয়েকটি রিট আবেদনের রায়ে ২০১১ সালের ১১ মার্চ মহামান্য আদালত—
১. কর্নেল তাহেরের বিচারকে অবৈধ, ২. গোপন সামরিক আদালতের সে বিচারকে লোক দেখানো প্রহসন, ৩. তাহেরের ফাঁসিকে ঠান্ডা মাথার পরিকল্পিত হত্যা, ৪. জিয়াকে তাহের হত্যার প্রধান পরিকল্পনাকারী, ৫. জিয়াকে ঠান্ডা মাথার খুনী, ৬. কর্নেল তাহেরকে মহান দেশপ্রেমিক, ৭. তাহেরের সহঅভিযুক্তগণ মহান দেশপ্রেমিক ও
৮. কর্নেল তাহেরকে একজন শহীদ ঘোষণা করার পাশাপাশি, ৯. সংশ্লিষ্ট ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণ প্রদানের, ১০. কর্নেল তাহেরের নামে ঢাকায় একটি সরকারি স্থাপনা বা সড়কের নামকরন করার, ও ১১. সর্বোপরি তাহের হত্যা প্রক্রিয়ায় জড়িত জীবিত দোষীদের আইনের আওতায় আনার নির্দেশ প্রদান করেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

scroll to top